রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪০ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক
বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে থামছে না যানবাহনে অগ্নিসংযোগ। গত ২৫ দিনে (২১ নভেম্বর পর্যন্ত) ১৯৫টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সিংহভাগই যানবাহনে। এসময় হাতেনাতে অনেককেই আটক করেছে স্থানীয়রা ও পুলিশ। আটকদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। তবে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সরাসরি বাসে আগুন দেওয়ার পরিবর্তে টার্গেট করছেন মাদকসেবী ও ভবঘুরেদের। তারা সামান্য টাকার বিনিময়ে নির্দ্বিধায় বাসে আগুন দিচ্ছেন। আর নাশকতার তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে জঙ্গিদের আদলে এনক্রিপ্টেড অ্যাপে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলের হরতাল-অবরোধ সফল করতে বাসে আগুন লাগানো হচ্ছে। মাদকসেবী ও ভবঘুরেরা যখন কোনো অপরাধ করে তাদের শনাক্ত করা কষ্টসাধ্য হয়। মাদকের টাকা জোগাড় করতে এসব মানুষ ঝুঁকি নিতে দ্বিধাবোধ করে না। যদি তাদের আটক করা হয় তবে তাকে কে আগুন দিতে বলেছে সেই ব্যক্তির নামটিও অনেক সময় বলতে পারে না।
জঙ্গিরা যেসব এনক্রিপ্টেড অ্যাপসের (এ অ্যাপস ব্যবহার করলে তাকে শনাক্ত করা যায় না) মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে সেসব অ্যাপস ব্যবহার করছে নাশকতাকারীরা। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এসব অ্যাপস দিয়ে আগুন লাগানোর তথ্য আদান-প্রদান করা হচ্ছে। যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টের না পায়।
নাশকতার ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে এ তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কখনো সরাসরি আবার কখনো নির্দেশনার মাধ্যমে যানবাহনে আগুন দেয়। এর মধ্যে সরাসরি আগুন দেওয়ার সময় অনেককে আটক করা হয়েছে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনায় তারা সরাসরি আগুন দিচ্ছিলেন।
সিটিটিসির তথ্যমতে, রাজধানীর মুগদা আইডিয়াল স্কুলের সামনে বাসে আগুন দেওয়ার সময় হাতেনাতে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তার মাধ্যমে নাশকতার সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা পর্যন্ত তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তে এ নাশকতার পেছনের অর্থদাতা, নিয়োগদাতাসহ সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মাধ্যমে নির্দেশনার তথ্য পেয়েছে সিটিটিসি। নাশকতাকারীদের ওপর নির্দেশনা ছিল যত বেশি গাড়িতে আগুন দেওয়া যায় ও মানুষ মারা যায়।
এগুলো সবই হয়েছে রাজনৈতিক কর্মসূচি কেন্দ্র করে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিআরটিসি বাসেও আগুন দেওয়া হচ্ছে। বাসে আগুন দেওয়ার জন্য প্রথমে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। পরবর্তীসময়ে দ্বিতীয়বার দ্বিগুণ টাকাও দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন এলাকা থেকে অপরাধীরা ঢাকায় এসে নাশকতা করছে। সম্প্রতি ঢাকাসহ সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিভিন্ন মামলার আসামিরা নাশকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে নাশকতা করছে।- র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্জন স্থান, রেললাইন, বাসস্টেশন ও ফুটওভার ব্রিজের আশপাশে থাকা মাদকসেবী এবং ভবঘুরেদের টার্গেট করছে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। তাদের এক বোতল পেট্রোল ও হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলা হচ্ছে সামনে যে বাস পাবে সেই বাসে পেট্রোল ছুড়ে মারতে। আবার বাসে উঠে যাত্রীবেশেও আগুন লাগানো হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে যানবাহনে আগুন ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কৌশল অবলম্বন করেছে। পুলিশ-র্যাবের সদস্যরা সাদা পোশাকে গণপরিবহনে যাত্রীবেশে উঠে নজরদারি করছেন। বাসের মধ্যে যাত্রীদের ছবি-ভিডিও তুলে রাখছেন। হঠাৎ চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।
অবরোধ-হরতালে পরিবহন বা স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগকারীদের ধরিয়ে দিলে অথবা সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন বলে ঘোষাণা দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এছাড়া ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের পক্ষ থেকেও একই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ডিএমপি থেকে।
গত ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় কাফরুলের তালতলায় বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে আগুন দেওয়ার সময় সিয়াম নামে এক কিশোরকে আটক করে স্থানীয়রা। পরে তাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে দেন তারা। এ ঘটনায় ওই কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পায়নি পুলিশ।
জানতে চাইলে কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফারুকুল আলম বলেন, ‘আটক সিয়ামের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, রাসেল নামে একজন ব্যক্তি তার সঙ্গে ছিল, সেই মূলত তাকে আগুন দিতে বলেছিল। তবে রাসেলের বিস্তারিত বলতে পারছে না সিয়াম।’
গত ১ নভেম্বর রাজধানীর মুগদাপাড়া আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে মিডলাইন পরিবহনের একটি বাসে যাত্রীবেশে আগুন দিয়ে পালানোর সময় আল-আমিন নামে একজনকে আটক করা হয়। আল-আমিন কার নেতৃত্বে কীভাবে বাসে আগুন দিয়েছেন তা স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় সিটিটিসির গোয়েন্দা দল আল-আমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তিনি বেশকিছু তথ্য দেন।
সিটিটিসির জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আল-আমিন জানান, বিএনপিকর্মী মিজানুর রহমান তাকে আগুন দিতে বলেন। বিনিময়ে তিন হাজার টাকা পেতেন আল-আমিন। এই মিজানের নেতৃত্বে আরও দুজন কমলাপুর টিটিপাড়া থেকে বাসে উঠে পেছনের সিটে গিয়ে বসেন। এরপর সঙ্গে থাকা পেট্রোল ঢেলে বাসে আগুন দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। মিজানসহ তিনজন পালিয়ে যেতে পারলেও স্থানীয়রা আল-আমিনকে ধরে ফেলেন। পরে মিজানকে গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়।
এরপর মিজান জিজ্ঞাসাবাদে সিটিটিসিকে জানান, আমির হোসেন রকি নামের মহানগর ছাত্রদলের একজন নেতার নেতৃত্বে তিনি রাজনীতি করেন। এই রকির নির্দেশনায় ও তত্ত্বাবধানে প্রথম দফায় মিডলাইন বাসসহ বেশ কয়েকটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এই নেতার কাছ থেকে সব রসদ পেয়ে চারজন বাসে আগুন দেওয়া শুরু করেন। এর বাইরে আরও বেশ কয়েকটি বাসে আগুন দিয়েছেন তারা।
সিটিটিসি জানায়, প্রথমদিনের অবরোধে মিজান এসে আল-আমিনের কাছে বোতলে পেট্রোল ও টাকা দেন। এসময় মিজান তাদের আশ্বস্ত করেন, তাদের দল ক্ষমতায় আসছে, কোনো সমস্যা হবে না। কমলাপুরের টিটিপাড়া থেকে খিলগাঁও সড়কে চলাচল করা বাসে আগুন দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় আল-আমিনকে। প্রতিটি বাসে আগুন দেওয়ার জন্য তিন হাজার টাকা বোনাস মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন রকি। পরে দ্বিতীয় দফার অবরোধে বাসে আগুন দেওয়ার জন্য ডাবল বোনাস ঘোষণা করেন।
গত ৬ নভেম্বর রাতে কুমিল্লা নগরীর ঢুলিপাড়া ভাঙা বিল্ডিং এলাকায় একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তিনটি মোটরসাইকেলযোগে তিনজন আরোহী রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন আমরা আগুন দেখে চিৎকার করলাম তখন মোটরসাইকেলগুলো শহরের দিকে চলে যায়। মোটরসাইকেলগুলোতে কারা ছিল তাদের চেনা যায়নি।
১৯ নভেম্বর গাজীপুরে দাঁড়িয়ে থাকা দূরপাল্লার একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে নিজের বাস পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে বাসের চালক ও মালিক দেলোয়ার হোসেন দেলু জ্ঞান হারান। পরে স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়ার মাদারবাড়ির মডেল মসজিদ এলাকায় পুড়ে যাওয়া তিনটি বাসের পাশে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছিলেন এক বৃদ্ধ। তার নাম সিরাজুল ইসলাম, বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের জনার কেঁওচিয়ার মাদারবাড়ি এলাকায়। তিনি পুড়ে যাওয়া শ্যামলী পরিবহন নামের দুটি বাসের মালিক।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকা থেকে অপরাধীরা ঢাকায় এসে নাশকতা করছে। সম্প্রতি ঢাকাসহ সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিভিন্ন মামলার আসামিরা নাশকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে নাশকতা করছে।’
মিরপুর থানার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে পেট্রোল হাতে দিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অন্য লোকদের দিয়ে আগুন দেওয়াচ্ছে। এমন ব্যক্তিরদের আমরা গ্রেফতার করেছি।’
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গত ২৮ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ২৫ দিনে হামলা ও নাশকতাসহ পরবর্তীসময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ও নাশকতার সঙ্গে জড়িত মোট ৬১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।’
তিনি বলেন, ‘সরাসরি বাসে আগুন দেওয়া বেশ কয়েকজনকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা গ্রেফতারের ভয়ে মাদকসেবী ও ভবঘুরেদের দিয়েও আগুন দিচ্ছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিডিও ফুটেজ এবং সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে র্যাব।
সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘২৮ অক্টোবর বিএনপির ডাকা অবরোধে সহিংসতার পরে হরতাল ও লাগাতার অবরোধে ধারাবাহিক নাশকতা চলছে। বিশেষ করে গণপরিবহনসহ বিভিন্ন যানবাহনে আগুন দেওয়া হচ্ছে। এসব নাশকতার নির্দেশনা আসছে বিশেষ এনক্রিপ্টেড অ্যাপসের মাধ্যমে।’
পুলিশের তৎপরতার মধ্যেও এ ধরনের নাশকতার নির্দেশদাতা কারা জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সশরীরে কর্মসূচি নেই। এখন তারা অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করছে। জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম চালাতে এনক্রিপ্টেড অ্যাপসের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। নাশকতার ক্ষেত্রেও এ ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব অ্যাপসে ছোট ছোট গ্রুপ খুলে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। তবে এ ধরনের সুরক্ষা ভেঙে তথ্য নিয়ে বেশ কয়েকজনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সূত্র : জাগো নিউজ